দশম শ্রেণির ইতিহাস সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা থেকে ৪ নম্বরের প্রশ্ন উত্তর ২০২২ | History Class 10 4th Chapter Question Answer PDF 2022
দশম শ্রেণির ইতিহাস সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা থেকে ৪ নম্বরের প্রশ্ন উত্তর ২০২২ | History Class 10 4th Chapter Question Answer PDF 2022
২০২২ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ইতিহাসের যেকটি অধ্যায় (৫টি) পরীক্ষা হবে, তার মধ্যে চতুর্থ অধ্যায়টি হলো 'সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা' । এই অধ্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৪ নম্বরের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো।
প্রশ্নমান = ৪
প্রশ্ন ১ = ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কেমন ছিল?
[উ] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। প্রথমে বহরমপুর, পরে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি বরং বিরোধিতা করেছিল। সমকালীন বিভিন্ন তথ্য থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিপাহি বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নলিখিত তথ্যগুলি থেকে—
(১) কিশোরীচাঁদ মিত্র ছিলেন সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট বাঙালি। তিনি লিখেছেন, এই বিপ্লব মূলত সৈনিকের বিপ্লব। জনসাধারণের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই।
(২) সমসাময়িক মনীষী শম্ভুচরণ মিত্র এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি একই কথা লিখেছেন।
(৩) রাজনারায়ণ বসু সিপাহি বিদ্রোহের সময় অন্যান্য শিক্ষিত বাঙালিদের মতো আতঙ্কিত ছিলেন এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিলিতে নিযুক্ত একজন সামরিক কর্মচারী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহী সিপাহিদের অত্যাচারের কাহিনি লিখেছেন এবং নিন্দা করেছেন।
(৪) রাজা রাধাকান্ত দেব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হরেন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্যরা সিপাহিদের নিন্দা ও ইংরেজ সরকারকে সাহায্যের কথা বলেন। কেবল বিদ্রোহী সিপাহি নয়, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতানেত্রীদের প্রতিও নিন্দা করা হয়।
(৫) সমসাময়িক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় সিপাহি বিদ্রোহের নিন্দা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
(৬) সে সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন ও মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন হিন্দু-মুসলমানদের রাজনৈতিক সভা ছিল। এই সভাগুলি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা ও ইংরেজ সরকারকে সমর্থনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
[] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার বাংলাদেশে প্রথম হয়েছিল। ফলে যে শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে তারা বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্ত ছিল। আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা স্থিতিশীল ছিল। বিদ্রোহ তাদের পদমর্যাদা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় শিক্ষিত বাঙালিরা সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে।
প্রশ্ন ২ = মহারানির ঘোষণাপত্র সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ দমন করার পর ভারতের ভারতের মুঘল শাসন ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটানো হয়। ভারতের শাসন ক্ষমতা ইংল্যান্ডের রানি মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং আনুষ্ঠানিকভাবে এলাহাবাদে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন তা ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’নামে পরিচিত।
[] ‘মহারানির ঘোষণাপত্রে’ বলা হয় যে,
(১) স্বত্ববিলোপ নীতি প্রত্যাহার করা হবে। দেশীয় রাজারা দত্তকপুত্র গ্রহণ করতে পারবেন। (২) দেশীয় রাজাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি মেনে চলা হবে। (৩) যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতীয়দের সরকারি চাকুরিতে সমান সুযোগ দেওয়া হবে। (৪) ভারতীয়দের প্রাচীন রীতিনীতি, ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।
[] দীর্ঘ ১০০ বছর (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যে অপশাসন চালিয়েছিল মহারানির ঘোষণাপত্র সেই অপশাসনে মধুর প্রলেপ দিয়েছিল। তবে মহারানি ভারতীয়দের যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোনোটিই সঠিকভাবে পালিত হয়নি। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘মহারানির ঘোষণা’—কে ‘প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৩ = বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] উনিশ শতকে বাংলার বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। তাই ড. অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভা-সমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। এই সভা-সমিতির যুগের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’।
প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা = ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এই সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রামমোহন রায়ের অন্যান্য শিষ্যরা।
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য = (১) সরকারি শাসনব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা। (২) জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করা।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কার্যাবলি = (১) বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। (২) ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় করলে তার বিরুদ্ধে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা জনসভা আহ্বান করে। বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে তার কার্যাবলি লক্ষ করে প্রখ্যাত গবেষক যোগেশচন্দ্র বাগল বলেছেন যে, এটিই হল ‘বাঙালি তথা ভারতবাসীর মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।'
প্রশ্ন ৪ = জমিদার সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] উনিশ শতকে বাংলায় অনেক সভা-সমিতি গড়ে উঠেছিল বলে ঐতিহাসিক অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। জমিদার সভা (Landholders Society) ছিল এই সময়ের একটি অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান।
জমিদার সভার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা = জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। জমিদার সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ। জমিদার সভার সভাপতি ছিলেন রাধাকান্ত দেব। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে এই সভার ‘প্রাণপুরুষ’বলা হয়।
জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য = (১) জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করা। (২) বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করার জন্য আন্দোলন করা। (৩) ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করা।
গুরুত্ব = জমিদার সভার কার্যাবলির প্রধান সাফল্য হল প্রতি গ্রামে দশ বিঘা পর্যন্ত নিষ্কর জমি রাখতে সরকারের সম্মতি আদায় করা। যদিও জমিদার সভা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এই প্রতিষ্ঠানই হল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত।
প্রশ্ন ৫ = ‘ভারতসভা’র উপর টীকা লেখ।
[উত্তর] ভূমিকা = উনিশ শতকে যে সব রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে ভারতসভা গড়ে ওঠে সমস্ত ভারতবাসীর স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে। এই সভায় যে-কোনো ভারতীয় সদস্য হতে পারত—কোনো ধর্মীয় ও বর্ণগত ভেদাভেদ ছিল না।
প্রতিষ্ঠা = ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা (Indian Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এই সভার প্রতিষ্ঠাতা।
উদ্দেশ্য = ভারতসভা প্রতিষ্ঠার কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল।
(১) দেশে জনমত গঠন করা।
(২) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা।
(৩) হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মৈত্রীর প্রসার ঘটানো।
(৪) রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত জনগণের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
আন্দোলন = মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত ভারতসভা। এই সভা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। যেমন—
(১) ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করেছিল। এর প্রতিবাদে এই সভা আন্দোলন করে।
(২) লর্ড লিটন দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইন পাস করলে ভারতসভা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। পরে সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে (১৮৮৩ খ্রি.)।
(৩) ইলবার্ট বিলের সমর্থন জানিয়েছিল ভারতসভা।
মূল্যায়ন = উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সমিতিগুলির মধ্যে ভারতসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ভারতসভা’ জাতীয় কংগ্রেসে মিশে যায়।
প্রশ্ন ৬ = 'আনন্দমঠ' গ্রন্থে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বিভিন্ন মনীষীদের লেখার অবদান উল্লেখযোগ্য। মনীষীদের এইসব লেখার মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হল—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস 'আনন্দমঠ'।
আনন্দমঠ উপন্যাসের রচনা ও প্রকাশ = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের রচয়িতা হলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘আনন্দমঠ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে।
আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমি হল অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বস্তর।
আনন্দমঠের মূল বিষয় = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে। এই উপন্যাসে সত্যানন্দের আহ্বানের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন দেশমাতার লাঞ্ছিত অপমানিত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি এই দেশমাতার উদ্ধারের জন্য একদল মাতৃভক্ত সন্তানের কথা বলে যুবসম্প্রদায়কে দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উৎসাহী করতে চেয়েছেন।
বন্দেমাতরম্ = বন্দেমাতরম্ গান ও স্লোগানটি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে রয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম্-এর অবদান অপরিসীম। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ ও তাঁর ‘বন্দেমাতরম্’ গানটির অবদান অপরিসীম। একারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক' বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন ৭ = জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির ভূমিকা লেখো।
[উত্তর] ভূমিকা = জাতীয়তাবোধ জাগরণের ক্ষেত্রে বহু মনীষীর লেখা গ্রন্থের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে।
বিষয়বস্তু = ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম ও রামকৃষ্ণের বাণী, ভারতীয় জীবনের আদর্শ—এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে।
জাতীয়তাবাদ = স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র দেশবাসীকে এক রূপে দেখেছিলেন। সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র দেশবাসীর প্রতি তিনি বলেন, “হে ভারত ...ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।”
মুক্তির বাণী = তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মবলিদানের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
অবদান = বিদেশি ইংরেজ শাসনে নির্যাতিত, শোষিত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যে বাণী দেন, তা পরবর্তীকালের বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর বাণীর মন্ত্রে ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। এজন্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৮ = 'গোরা' উপন্যাসে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে—সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
[উত্তর] যে সব মনীষীদের লেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার কথা ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।
রচনা ও প্রকাশ = ‘গোরা’উপন্যাসটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘গোরা’উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।
গোরা উপন্যাসের মূল বিষয় জাতীয়তাবোধ = বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকি চরিত্র হল এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা। জাতীয়তাবোধের বিকাশে বহু উপন্যাসের মধ্যে গোরা উপন্যাসটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এই উপন্যাসে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ ও সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন। এই উপন্যাসে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভারতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ব্যক্ত হয়েছে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসের মাধ্যমে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক দিক নির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দেশিত পথ—সেবা, ভক্তির।
প্রশ্ন ৯ = ‘ভারতমাতা’ চিত্রে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উত্তর] পরাধীন ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পীরা চিত্রের মাধ্যমেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটিয়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’চিত্রটি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। ‘ভারতমাতা’হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক।
ভারতমাতা চিত্র = ‘ভারতমাতা’এঁকেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’চিত্র অঙ্কন করেন। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তা ‘ভারতমাতা’রূপে খ্যাতি লাভ করে।
ভারতমাতার চিত্রের বর্ণনা = ভারতমাতা হলেন গৈরিক বসন পরিহিতা দেবী। ভারতমাতার চারটি হাত। তিনি চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, সাদা কাপড়, বেদ ও জপমালা। তিনি সবুজ পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।
ভারতমাতা ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি তাঁর সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ভারতমাতা চিত্রটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে। ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’-র খুব প্রশংসা করেছিলেন।
[উ] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। প্রথমে বহরমপুর, পরে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি বরং বিরোধিতা করেছিল। সমকালীন বিভিন্ন তথ্য থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিপাহি বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নলিখিত তথ্যগুলি থেকে—
(১) কিশোরীচাঁদ মিত্র ছিলেন সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট বাঙালি। তিনি লিখেছেন, এই বিপ্লব মূলত সৈনিকের বিপ্লব। জনসাধারণের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই।
(২) সমসাময়িক মনীষী শম্ভুচরণ মিত্র এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি একই কথা লিখেছেন।
(৩) রাজনারায়ণ বসু সিপাহি বিদ্রোহের সময় অন্যান্য শিক্ষিত বাঙালিদের মতো আতঙ্কিত ছিলেন এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিলিতে নিযুক্ত একজন সামরিক কর্মচারী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহী সিপাহিদের অত্যাচারের কাহিনি লিখেছেন এবং নিন্দা করেছেন।
(৪) রাজা রাধাকান্ত দেব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হরেন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্যরা সিপাহিদের নিন্দা ও ইংরেজ সরকারকে সাহায্যের কথা বলেন। কেবল বিদ্রোহী সিপাহি নয়, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতানেত্রীদের প্রতিও নিন্দা করা হয়।
(৫) সমসাময়িক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় সিপাহি বিদ্রোহের নিন্দা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
(৬) সে সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন ও মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন হিন্দু-মুসলমানদের রাজনৈতিক সভা ছিল। এই সভাগুলি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা ও ইংরেজ সরকারকে সমর্থনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
[] পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার বাংলাদেশে প্রথম হয়েছিল। ফলে যে শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে তারা বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্ত ছিল। আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থা স্থিতিশীল ছিল। বিদ্রোহ তাদের পদমর্যাদা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় শিক্ষিত বাঙালিরা সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে।
প্রশ্ন ২ = মহারানির ঘোষণাপত্র সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ দমন করার পর ভারতের ভারতের মুঘল শাসন ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটানো হয়। ভারতের শাসন ক্ষমতা ইংল্যান্ডের রানি মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং আনুষ্ঠানিকভাবে এলাহাবাদে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন তা ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’নামে পরিচিত।
[] ‘মহারানির ঘোষণাপত্রে’ বলা হয় যে,
(১) স্বত্ববিলোপ নীতি প্রত্যাহার করা হবে। দেশীয় রাজারা দত্তকপুত্র গ্রহণ করতে পারবেন। (২) দেশীয় রাজাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি মেনে চলা হবে। (৩) যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতীয়দের সরকারি চাকুরিতে সমান সুযোগ দেওয়া হবে। (৪) ভারতীয়দের প্রাচীন রীতিনীতি, ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।
[] দীর্ঘ ১০০ বছর (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যে অপশাসন চালিয়েছিল মহারানির ঘোষণাপত্র সেই অপশাসনে মধুর প্রলেপ দিয়েছিল। তবে মহারানি ভারতীয়দের যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোনোটিই সঠিকভাবে পালিত হয়নি। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘মহারানির ঘোষণা’—কে ‘প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৩ = বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] উনিশ শতকে বাংলার বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। তাই ড. অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভা-সমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। এই সভা-সমিতির যুগের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’।
প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা = ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এই সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রামমোহন রায়ের অন্যান্য শিষ্যরা।
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য = (১) সরকারি শাসনব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা। (২) জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করা।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কার্যাবলি = (১) বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। (২) ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় করলে তার বিরুদ্ধে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা জনসভা আহ্বান করে। বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে তার কার্যাবলি লক্ষ করে প্রখ্যাত গবেষক যোগেশচন্দ্র বাগল বলেছেন যে, এটিই হল ‘বাঙালি তথা ভারতবাসীর মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।'
প্রশ্ন ৪ = জমিদার সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] উনিশ শতকে বাংলায় অনেক সভা-সমিতি গড়ে উঠেছিল বলে ঐতিহাসিক অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। জমিদার সভা (Landholders Society) ছিল এই সময়ের একটি অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান।
জমিদার সভার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা = জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। জমিদার সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ। জমিদার সভার সভাপতি ছিলেন রাধাকান্ত দেব। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে এই সভার ‘প্রাণপুরুষ’বলা হয়।
জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য = (১) জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করা। (২) বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করার জন্য আন্দোলন করা। (৩) ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করা।
গুরুত্ব = জমিদার সভার কার্যাবলির প্রধান সাফল্য হল প্রতি গ্রামে দশ বিঘা পর্যন্ত নিষ্কর জমি রাখতে সরকারের সম্মতি আদায় করা। যদিও জমিদার সভা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এই প্রতিষ্ঠানই হল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত।
প্রশ্ন ৫ = ‘ভারতসভা’র উপর টীকা লেখ।
[উত্তর] ভূমিকা = উনিশ শতকে যে সব রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে ভারতসভা গড়ে ওঠে সমস্ত ভারতবাসীর স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে। এই সভায় যে-কোনো ভারতীয় সদস্য হতে পারত—কোনো ধর্মীয় ও বর্ণগত ভেদাভেদ ছিল না।
প্রতিষ্ঠা = ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা (Indian Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এই সভার প্রতিষ্ঠাতা।
উদ্দেশ্য = ভারতসভা প্রতিষ্ঠার কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল।
(১) দেশে জনমত গঠন করা।
(২) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা।
(৩) হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মৈত্রীর প্রসার ঘটানো।
(৪) রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত জনগণের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
আন্দোলন = মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত ভারতসভা। এই সভা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। যেমন—
(১) ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করেছিল। এর প্রতিবাদে এই সভা আন্দোলন করে।
(২) লর্ড লিটন দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইন পাস করলে ভারতসভা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। পরে সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে (১৮৮৩ খ্রি.)।
(৩) ইলবার্ট বিলের সমর্থন জানিয়েছিল ভারতসভা।
মূল্যায়ন = উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সমিতিগুলির মধ্যে ভারতসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ভারতসভা’ জাতীয় কংগ্রেসে মিশে যায়।
প্রশ্ন ৬ = 'আনন্দমঠ' গ্রন্থে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উ] ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বিভিন্ন মনীষীদের লেখার অবদান উল্লেখযোগ্য। মনীষীদের এইসব লেখার মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হল—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস 'আনন্দমঠ'।
আনন্দমঠ উপন্যাসের রচনা ও প্রকাশ = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের রচয়িতা হলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘আনন্দমঠ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে।
আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমি হল অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বস্তর।
আনন্দমঠের মূল বিষয় = ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে। এই উপন্যাসে সত্যানন্দের আহ্বানের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন দেশমাতার লাঞ্ছিত অপমানিত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি এই দেশমাতার উদ্ধারের জন্য একদল মাতৃভক্ত সন্তানের কথা বলে যুবসম্প্রদায়কে দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উৎসাহী করতে চেয়েছেন।
বন্দেমাতরম্ = বন্দেমাতরম্ গান ও স্লোগানটি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে রয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম্-এর অবদান অপরিসীম। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ ও তাঁর ‘বন্দেমাতরম্’ গানটির অবদান অপরিসীম। একারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক' বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন ৭ = জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির ভূমিকা লেখো।
[উত্তর] ভূমিকা = জাতীয়তাবোধ জাগরণের ক্ষেত্রে বহু মনীষীর লেখা গ্রন্থের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে।
বিষয়বস্তু = ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম ও রামকৃষ্ণের বাণী, ভারতীয় জীবনের আদর্শ—এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে।
জাতীয়তাবাদ = স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র দেশবাসীকে এক রূপে দেখেছিলেন। সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র দেশবাসীর প্রতি তিনি বলেন, “হে ভারত ...ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।”
মুক্তির বাণী = তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মবলিদানের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
অবদান = বিদেশি ইংরেজ শাসনে নির্যাতিত, শোষিত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যে বাণী দেন, তা পরবর্তীকালের বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর বাণীর মন্ত্রে ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। এজন্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৮ = 'গোরা' উপন্যাসে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে—সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
[উত্তর] যে সব মনীষীদের লেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার কথা ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।
রচনা ও প্রকাশ = ‘গোরা’উপন্যাসটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘গোরা’উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।
গোরা উপন্যাসের মূল বিষয় জাতীয়তাবোধ = বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকি চরিত্র হল এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা। জাতীয়তাবোধের বিকাশে বহু উপন্যাসের মধ্যে গোরা উপন্যাসটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এই উপন্যাসে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ ও সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন। এই উপন্যাসে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভারতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ব্যক্ত হয়েছে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসের মাধ্যমে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক দিক নির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দেশিত পথ—সেবা, ভক্তির।
প্রশ্ন ৯ = ‘ভারতমাতা’ চিত্রে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
[উত্তর] পরাধীন ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পীরা চিত্রের মাধ্যমেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটিয়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’চিত্রটি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। ‘ভারতমাতা’হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক।
ভারতমাতা চিত্র = ‘ভারতমাতা’এঁকেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’চিত্র অঙ্কন করেন। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তা ‘ভারতমাতা’রূপে খ্যাতি লাভ করে।
ভারতমাতার চিত্রের বর্ণনা = ভারতমাতা হলেন গৈরিক বসন পরিহিতা দেবী। ভারতমাতার চারটি হাত। তিনি চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, সাদা কাপড়, বেদ ও জপমালা। তিনি সবুজ পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।
ভারতমাতা ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি তাঁর সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ভারতমাতা চিত্রটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে। ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’-র খুব প্রশংসা করেছিলেন।