নীরদ নয়নে নীরঘন সিঞ্চনে, গোবিন্দদাস, গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ
প্রিয় শিক্ষার্থীরা,
বৈষ্ণব পদাবলীর মূল পদ ব্যাখ্যাসহ পোস্ট এখানে দেওয়া হলো।
নীরদ নয়নে নীরঘন সিঞ্চনে, গোবিন্দদাস, গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ
গোবিন্দদাস । গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ
নীরদ নয়নে নীরঘন সিঞ্চনে
পুলক-মুকুল অবলম্ব।
স্বেদ মকরন্দ বিন্দু বিন্দু চুয়ত
বিকশিত ভাব-কদম্ব।।
কি পেখলুঁ নটবর গৌরকিশোর
অভিনব হেম কল্পতরু সঞ্চরু
সুরধুনী-তীরে উজোর।।
চঞ্চল চরণ কলমতলে ঝঙ্করু
ভকতভ্ৰমরগণ ভাের।
পরিমলে লুবধ সুরাসুর ধাবই
অহনিশি রহত অগাের।।
অবিরত প্রেম রতন ফল বিতরণে
অখিল মনােরথ পুর ।
তাকর চরণে দীনহীন বঞ্চিত
গােবিন্দদাস রহুঁ দূর।।
আলােচনা
আলোচ্য পদে শ্রীগৌরাঙ্গের অনুপম ভাবকান্তি এবং করুণাঘন, রসস্নিগ্ধ, দিব্য মাধুরীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। শ্রীগৌরাঙ্গের কৃষ্ণকালাে নয়নরূপ মেঘ থেকে অবিরাম ধারায় প্রেমাশ্রু পতিত হচ্ছে। আর্ত জগজ্জনের জন্য এই অশ্রুবর্ষণ। তাঁর দেহবল্লরীতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। সেইসব ঘর্মবিন্দু আসলে অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবের (স্বেদ, অশ্রু, পুলক, বিবর্ণ, ধর্ম প্রভৃতি) সমূহ প্রকাশ। গোরাচাঁদের সেই অপরূপ দিব্যমূর্তি দেখে বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না। শ্ৰীগৌরাঙ্গ যেন অভিনব হেম-কল্পতরু। তাপিত, তৃষিত আর্তজনকে তিনি বাঞ্ছিত ফল প্রদান করেন। তাই তিনি বাঞ্ছা-কল্পতরু।
শ্রীচৈতন্যদেবের গলানাে সােনার মত গাত্রধর্ম, উন্নত দেহ, আজানুলম্বিত বাহু, উন্নত গ্রীবা, আয়ত কৃষ্ণচক্ষু—সব মিলিয়ে অজ্ঞাতে ও বিরাটত্বের আভাস। কিন্তু এই কল্পতরু অভিনব। কারণ, প্রথমত এটি সােনার। সাধারণ বৃক্ষ তো আর সোনার হয়না। দ্বিতীয়ত তরু স্থাবর, জঙ্গম নয়, কিন্তু গৌরাঙ্গ-রূপী বাঞ্ছা-কল্পতরু নদীতীরে সঞ্চরণমান। সুরধুনী তীরে তিনি উজ্বলরূপে বিরাজমান। গৌরাঙ্গদেব অবিরত সঞ্চরমান। তাই চঞ্চল চরণ বলা হয়েছে। কিন্তু ভ্রমর যেমন পদ্মের সৌরভে আকৃষ্ট হয়ে পদ্মের কাছে চলে আসে এবং গুণ গুণ সুর তােলে, তেমনি ভক্তগণ চৈতন্যদেবের চরকমলের সৌরভে আকৃষ্ট হয়ে সেখানে সমবেত হয়ে গুঞ্জন করছে এবং মধুপানে মত্ত ও বিভাের হয়ে পড়ে আছে।
তাঁর চরণকমলের পরিমলে লুব্ধ হয়ে দেবতা, দানব সকলেই তা পাওয়ার জন্য ধাবিত হচ্ছে। আর শ্রীগৌরাঙ্গ তাে করুণাসাগর। তাঁর কৃপাপ্রার্থী কাউকেই প্রেমভক্তিরস আস্বাদনের সুযােগ থেকে তিনি বঞ্চিত করেন না। তাই সুরাসুর সকলেই তাঁর চরণকমলের মধু পান করে অহর্নিশি অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। মহাপ্রভু অকৃপণ দাতা। তিনি অবিরত প্রেমরতন-ফল বিতরণ করে অখিলের মনােবাসনা পূরণ করেছেন। কিন্তু গােবিন্দদাসের এমন দুর্ভাগ্য, তিনি এমন দীনহীন যে, মহাপ্রভুর চরণম্পর্শের সুযােগ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।
গােবিন্দদাস শ্রীচৈতন্যদেবের অপ্রকট হওয়ার (১৫৩৩ খ্রি.) এক বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং মহাপ্রভুকে দর্শনের সুযােগ তিনি পাননি। সেই মানসিক যন্ত্রণা তিনি তাঁর সৃষ্ট সব পদেই ব্যক্ত করেছেন।
আলােচ্য পদটি গৌরাঙ্গাবিষয়ক কিন্তু গৌরচন্দ্রিকা নয়। পদটিতে রাধাভাবে বিভাবিত গৌরাঙ্গের মূর্তি নয়, করুণাঘন, বাঞ্ছা-কল্পতরু শ্রীচৈতন্যের দিব্যমূর্তি অঙ্কিত হয়েছে। ভাবের গভীরতায়, মণ্ডনকলার পারিপাট্যে, রসের স্ফূরণে পদটি এক অনুপম কাব্যশিল্প হয়ে উঠেছে।
------------------------------------------------------------
আমাদের টেলিগ্রাম ও ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হোন